সুলতান সুলেমানদের পাখিপ্রীতি থেকে সৃষ্ট অপূর্ব স্থাপনা - history bangla24

সুলতান সুলেমানদের পাখিপ্রীতি থেকে সৃষ্ট অপূর্ব স্থাপনা

Share This



বর্তমান তুরস্ককেন্দ্রিক ‘অটোমান’ শাসন ছিলো একসময় মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বে প্রভাব বিস্তারকারী সাম্রাজ্য। ইদানীংকালের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’ এই অটোমান সাম্রাজ্যের কাহিনী নিয়েই তৈরি। পরাক্রমশালী এই অটোমান শাসকদের নানা বিষয়ে উৎকর্ষের মাঝে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে যা এখনো টিকে আছে, তা হলো অটোমান স্থাপত্যশৈলী। নান্দনিকতা, কারিগরী আর ইসলামী ভাবধারার ভারসাম্যে অটোমান স্থাপত্য স্বর্গীয় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।
অটোমান শাসক দ্বিতীয় মেহমুদ ‘কনস্টান্টিনোপল’ অর্থাৎ বর্তমান ইস্তাম্বুল দখল করে নিলে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিস্তৃত সাম্রাজ্যে। ভূ-প্রকৃতির বিস্তারের পাশাপাশি তুর্কি সংস্কৃতি, কলা আর স্থাপত্যেও পরিবর্তন ও উৎকর্ষ আসতে থাকে যখন তৎকালীন সভ্যতার সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত এই নগর অটোমানদের কব্জায় আসে।

প্রতিটি প্রাচীন স্থাপনার দেয়ালে দেখা যায় পাখির বাসা; Source: Caner Cangül
এরপর থেকেই ইস্তাম্বুল হতে থাকে অটোমানদের নান্দনিক স্থাপত্য গড়ার কেন্দ্রবিন্দু। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে ইস্তাম্বুলের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ ‘হাজিয়া সোফিয়া’র কথা, যেটি ছিল বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সময়কার গির্জা; যা তারা পরে রূপান্তর ঘটায় সুন্দর এক মসজিদে। নির্মাণকাজের দক্ষতা দিয়ে অটোমানরা গড়ে তোলে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, প্রাসাদ আর দুর্গ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর যুদ্ধ বিগ্রহ বাঁচিয়ে তার কিছু আজও টিকে আছে।
দৃষ্টিনন্দন এসব স্থাপনা নানা দিক থেকেই স্বতন্ত্র তো বটেই, একটি দিক থেকে একেবারেই আলাদা। তা হলো, স্থাপনাগুলোতে পাখির জন্যে আলাদা নিবাসের ব্যবস্থা থাকা। নানা দুর্গ, মসজিদ আর প্রাসাদের দেয়ালের গায়ে ঝুলন্ত আকারে দেখা যাবে অবিকল বড় প্রাসাদের প্রতিরূপ। সেগুলো বানানো হয়েছে পাখপাখালি থাকার জন্য।

কিছু পাখির বাসা মসজিদের আদলে তৈরি; Source: tripadvisor, sihirlitur
বাসাগুলো বানানো হয়েছে বড় বড় প্রাসাদের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি আকারে। বাইরের দেয়ালে লেগে থাকা বহুতল ভবনের ন্যায় বাসাগুলোতে রয়েছে বিস্তারিত ও সূক্ষ্ম কারুকাজ, এমনকি ফোয়ারা পর্যন্ত! প্রাসাদের মতো দেখতে এই ক্ষুদ্র পাখির বাসাগুলো পাখির প্রতি অটোমান শাসকদের ভালোবাসা আর মমতার প্রতীক।
আকাশে ওড়ার অনন্য ক্ষমতার কারণে সময়ের শুরু থেকেই পাখপাখালি ছিল মানুষের জন্য শিল্প ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার উৎস। পাখি সর্বদাই শান্তি, মুক্তি এবং কখনো শক্তিরও প্রতীক। অভিকর্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সদর্পে আকাশে ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতার কারণে নানা সংস্কৃতিতে পাখিকে দেখা হয় এক আশ্চর্য সৃষ্টি হিসেবে। যার কারণে বিজ্ঞান আর শিল্পকলা উভয় জায়গাতেই ছিল পাখি নিয়ে মাতামাতি। তুরস্কের সংষ্কৃতিতে ঘুঘু হচ্ছে ভালোবাসা এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক, কবুতর হলো শান্তি এবং চড়ুই পাখি ঘরের নিরাপত্তার প্রতীক। তুর্কি বিশ্বাস অনুযায়ী পাখির আবাস নষ্ট করা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে।

তুরস্কের কোনো এক প্রাসাদের অনুকরণে তৈরি পাখির বাসা; Source: Caner Cangül
এসব বিশ্বাস পর্যালোচনা করে ধারণা করা যায়, তুরস্কের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস তাদের পাখিপ্রেমের মূল প্রেরণা। এ কারণে সবসময়ই মানুষ পাখিকে তাদের আশপাশেই জায়গা করে দিয়েছে, বানিয়ে দিয়েছে ঘর, যা পাখিদের শিকারী ও খারাপ আবহাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। সময়ের সাথে সাথে এসব সাদামাটা পাখির বাসাগুলোতে সমৃদ্ধ স্থাপত্যশৈলী আর আলংকারিক উপাদান যোগ হয়ে রূপ নেয় অনন্য সব স্থাপনায়, যা রীতিমতো পরিণত হয় অটোমান স্থাপত্যশৈলীর এক গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে।
যদিও ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অটোমানরা ক্ষমতায় আসার আগে থেকে আগের শাসকদের আমল থেকেই পাখিদের থাকার জন্যে এ জাতীয় বাসস্থান তৈরি করার চল ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিলো অনেকটাই সাদামাটা। ১৮ শতকের শুরুর দিক থেকে কারুকার্যময় এসব পাখির বাসা অটোমান স্থাপত্যের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

পাখির বাসাগুলোতে দেখা যায় সূক্ষ্ম কারুকাজ; Source: Caner Cangül
পাখির বাসাগুলো শুধুই সাধারণ ইট সুরকির স্থাপনা নয়, একটা পূর্ণাঙ্গ প্রাসাদের যেসব খুঁটিনাটি থাকে, তা সবই রয়েছে এসবে। একতলা বাসা থেকে বহুতল বিশিষ্ট বাসা- সবরকমই পাওয়া যাবে। প্রাসাদগুলোর ভেতরে রয়েছে ঘর, ঘরের সামনে বারান্দার ন্যায় জায়গাও, যেখানে বসে দিব্যি রোদ পোহাতে পারে পাখিরা। কয়েকটিতে রাখা থাকে পানির পাত্র, পাখিদের পানির তেষ্টা মেটানোর ব্যবস্থা। কয়েকটিতে আছে ‘রানওয়ে’ ধাঁচের জায়গা, যেখান থেকে পাখিরা ওড়ার জন্যে ওঠানামা করতে পারে। এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সবক্ষেত্রেই পাখির বাসাগুলো বানানো হয়েছে মানুষ এবং অন্যান্য শিকারী প্রাণীর নাগালের বাইরে, উঁচু স্থানে।
প্রতিটি বাসা পুরো তুরস্ক জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভবনের অনুকরণে তৈরি করা। মূলত আমাদের চারপাশে থাকা সাধারণ পাখি সমূহ, যেমন চড়ুই, কোকিল, কবুতর ইত্যাদি পাখি এসব বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করত। প্রতিটি বাসার রয়েছে বিভিন্ন নাম, যেমন kuş köşkü (পাখি শিবির), serçe saray (চড়ুই মহল), güvercinlik (পায়রার খোপ)। এগুলোর কোনোটি শুধু পাখিদের আশ্রয়ের জন্য, আবার কোনোটিতে পাখিদের জন্য রাখা আছে খাবারের ব্যবস্থা।

কিছু বাসা খুবই সাধারণ দেখতে, অনেকটা গুহার মতো; Source: sihirlitur
পাখির বাসাগুলোকে স্থপতিরা প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করেছেন নির্মাণকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর উপর ভিত্তি করে। কিছু বাসা দেয়ালের গা ঘেঁষে সারিবদ্ধ ছিদ্র আকারে তৈরি, এসব ছিদ্র মূলত পাখির প্রবেশপথ। ছিদ্র পার হয়ে পাখিরা ভেতরে ঢোকে, ভেতরে খোপ আকারে জায়গা থাকে। বাসাগুলো অনেকটা পাহাড়ের গুহার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ জাতীয় বাসার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ্য ইস্তাম্বুলের সোলাইমানিয়াহ মসজিদের গাত্র সংলগ্ন পাখির বাসা।
আরেক ধরনের বাসা আছে যেগুলো সবচেয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত, এগুলো দেয়ালের সাথে লেগে থাকা ঝুলন্ত কিছু প্রাসাদসম বাসা। এতে থাকে জানালা, গম্বুজ, তোরণ, সুন্দর কারুকাজ করা খিলান ইত্যাদি। গবেষকদের অনেকেই এসব পাখির বাসাকে বর্ণনা করেছেন ভাস্কর্যের সমকক্ষ একটি শিল্প হিসেবে।
ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে পুরনো পাখির বাসাগুলো রয়েছে ‘কানুনি সুলতান সুলেমান ব্রিজ’ এর দেয়ালে। ১৫৬৭ সালে উদ্বোধন হওয়া এই প্রাচীন সেতুর গা ঘেঁষে আছে অনেক পাখির বাসা। ১৮ শতকে তৈরি আরো কিছু বাসা দেখতে পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক ‘ইয়েনি ভালিদ’ মসজিদের দেয়ালে, যেগুলো কিনা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত পাখির বাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই মসজিদের দেয়ালের পাখির বাসাগুলো অনেকটা মসজিদের আদলেই তৈরি, বাসাগুলোর দু’পাশের লাগোয়া মিনার দেখে তেমনটাই প্রতিভাত হয়।

‘ইয়েনি ভালিদ’ মসজিদের বিভিন্ন কোণে দেখা যায় পাখির পানি পানের ব্যবস্থা; Source: İhsan Deniz Kılıçoğlu, İdil Elveriş
কিছু ক্ষেত্রে এসব পাখির বাসায় এত বিস্তারিত নকশা ও সাধারণ বাড়িঘরের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায় যে, অনেক বিশেষজ্ঞই এগুলোকে আলাদাভাবে পুরাকৌশল ও স্থাপত্য বিষয়ক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বলে মত দিয়েছেন। প্রকৌশলগত দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, সব ক’টি পাখির বাসাই মূলত ‘ক্যান্টিলিভার’ পদ্ধতিতে দেয়াল থেকে গড়া হয়েছে।
কিন্তু আধুনিককালে কংক্রিট ঢালাই দিয়ে যেভাবে সহজে ক্যান্টিলিভার বানানো যায়, সে যুগে সেটা সম্ভব ছিল না। তৎকালীন তুর্কি ওসামানীয় কারিগরদের দক্ষতা ছিল সারা বিশ্বে সেরা। তারা এটি সম্ভব করেছিলো ‘মালাকারি’ নামক এক কৌশল ব্যবহার করে। এই কৌশল মূলত ব্যবহার করা হয়ে গম্বুজ ও দেয়ালে পুরু প্লাস্টারের মাধ্যমে নকশা করার কাজে। ধাপে ধাপে প্লাষ্টার করে পাখির বাসাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে।
তিন-চারশ বছর আগে গড়ে ওঠা এসব পাখির বাসার অধিকাংশই নষ্ট হয়েছে গিয়েছে বৃষ্টি-বাদলা, খারাপ আবহাওয়া এবং যত্নের অভাবে। অল্প যেগুলো অবশিষ্ট আছে, তা টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পর্যটক তো বটেই, গবেষক-শিল্পী-স্থপতি সবার কাছেই এগুলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

তথ্যসূত্র: roar media

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Pages